সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বুলবুল আহমেদ

শামসুন নাহারঃ অগ্নি পরিধির যাত্রী :

কঠোর উপল আঘাত সহিয়া, লঙ্ঘিয়া বাধা কত
বিকশিত করি তুলেছ নিজেরে সূর্যকরের মত...
অন্ধ ঘরের বন্ধনে এক আলোক পিয়াসী পাখি
একদা এক আলোক দ্যুতির সংকেতে উঠি ডাকি
---- সুফিয়া কামাল
চলে যাওয়া বিশ শতকের গোড়ার কথা। তখন এ উপমহাদেশের মুসলমানদের জীবনে অশিক্ষার এক নিঃসীম অন্ধকার। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে চরম দিশেহারা মুসলমান সম্প্রদায় ইংরেজ শাসনাধীনে সেদিন পর্যন্ত আধুনিক শিক্ষার প্রতি বিমুখ। শিক্ষার অভাবে জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই তারা পিছিয়ে পড়ছে, জীবনাচরণে ও মননে জড়তা আসছে এবং অসংগত ধর্মীয় গোঁড়ামির বাতাবরণে প্রায় স্তদ্ধ হতে বসেছে মুক্ত ভাবনা। মহিলাদের অবস্থা
সবচেয়ে করুণ। ব্রাহ্মসমাজের দৌলতে প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের মেয়েরা কিছুটা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন শিক্ষার, বাইরের জগতটাকে দেখার, নিজেদের প্রতিভার সামান্য সাক্ষর রাখতে। তখন উদয়তারার পথ বেয়ে এলেন রোকেয়া- মুসলিম মেয়েদের জীবনে শিক্ষার আলো জ্বালতে। আর একটি জীবের স্পর্শে ঘুম ভাঙে কত জীবনের, তার খবর কখনও পাওয়া যায়, আবার কখনও যায় না। আমাদের সৌভাগ্য রোকেয়ার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন শামসুন নাহার মাহমুদ। বাংলার মুসলিম নারী সমাজের জাগরণের শঙ্কাতুর মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র। শিক্ষা, সাহিত্য ও সমাজসেবার যে পথ ধরে রোকেয়া চলেছিলেন, সে কাজ অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছেন শামসুন নাহার মাহমুদ তাঁর নানা কাজের মাধ্যমে। আজ আমরা নারীর যে ক্ষমতায়নের কথা বলি, বাংলাদেশে সেই কাজই করেছিলেন রোকেয়া। আত্মনির্ভরশীলতা দিতে চাইছিলেন নারীকে শিক্ষার মধ্যে দিয়ে। এই প্রক্রিয়ার মূর্ত প্রকাশ শামসুন নাহার মাহমুদ। রোকেয়াই প্রথম। যেমন সময়ে, তেমনি অবস্থানে। একই ধারার মানুষ তাঁরা, একই সঙ্গে আকাশের এবং পৃথিবীর। আকাশের মুক্তি চেয়ছেন, পৃথিবীকে অস্বীকার না করে। তাঁরা চেয়েছেন সমাজের আর পাঁচ জনের মনে বড়োত্বের আকাঙ্ক্ষা জাগাতে। সময়ের নিরিখে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের নোয়াখালি জেলায় ১৯০৮ সালে শামসুন নাহার মাহমুদের জন্ম হয়। তাঁর পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কয়েক প্রজন্ম ধরে শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। নাহারের পিতা ও কাকারা সবাই উচ্চশিক্ষিত ছিলেন- তখনকার দিনের গ্রাজুয়েট। তবে পরিবারের নারী সদস্যরা কেউ লেখাপড়া শিখেছিলেন বলে শোনা যায় না। যদিও তাঁর মাতামহ আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে কয়েকজন ১৮৮৩ সালে ঢাকা মুসলমান সুহৃদ সম্মিলনী প্রতিষ্ঠা করেন অবরোধবাসিনীদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে। এই সম্মিলনীর উৎসায়ী সদস্যদের সহযোগিতায় ঘরে বসে মেয়েরা স্কুলপাঠ্য বই পড়ে পরীক্ষা দিয়ে উচ্চতর শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হতে পারতেন। শামসুন নাহারারে মাতামহী এভাবে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া শিখেছিলেন। তাঁর মেয়েরাও সবাই ভালো বাংলা ও উর্দু জানতেন। শামসুন নাহারই পরিবারের প্রথম মেয়ে যাকে স্কুলে ভর্তি করা হয়। নাহারের বাবা নুরুল্লাহ চৌধুরী মারা যান মাত্র বাইশ বছর বয়সে। তখন তাঁর মা আসিয়া খাতুন তিন বছরের হবীবুল্লাহ বাহার ও ছয় মাসের শামসুন নাহারকে নিয়ে চট্টগ্রামে বাবার বাড়িতে চলে আসেন। মাতামহ খানবাহাদুর আব্দুল আজিজ তখন চট্টগ্রামের ডিভিশনাল স্কুল ইন্সপেক্টর। এখানে খাস্তগীর স্কুলে নাহার ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। তারপর সমাজের চাপে তাঁর পড়া বন্ধ হয়ে যায়। এ নিয়ে তাঁর মনে ক্ষোভ ছিল খুব। তিনি পরে নজরুলকে যেমন দেখেছি বইয়ে লিখেছেন, বছর বয়সে ফরমান জারি হল স্কুল ছাড়তে হবে। সেই থেকে বাড়ি বসে বইপত্র নাড়াচাড়া করি। বছরের পর বছর কাটে। চোখের সামনে সহপাঠি হিন্দু, ব্রাহ্ম, ক্রিশ্চান মেয়েরা অবাধে চলাফেরা করে, ক্লাসের পর ক্লাস ডিঙিয়ে যায়, ম্যাট্রিক পাশ করে কেউ কেউ পড়তে যায় কলকাতার বেথুন কলেজে, ডায়াসেশান কলেজে। মাঝে মাঝে তারা চিঠিপত্র দেয়, তাতে থাকে নতুন দুনিয়ার ইঙ্গিত। আমাদের পাশের বাড়ির বৌদ্ধ পরিবারের মেয়ে স্কুলে আমার চেয়ে উঁচু ক্লাসের ছাত্রী, দিদি জ্যোতির্ময়ী চৌধুরী (পরে বিলেত দেশটা মাটির গ্রন্থের লেখিকা জ্যোতির্মালা দেবী) চট্টগ্রাম, কলকাতা ও রেঙ্গুনে পড়াশোনা করে উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিলাত পাড়ি দিলেন। মনে হয়, আমরা অন্ধকারের জীব, আর ওরা, আলোর দেশের বাসিন্দা। দিনের পর দিন মনের মধ্যে কেবলই গুমরাতে থাকে বিদ্রোহ”।
তখনকার রক্ষণশীল গোঁড়া মুসলিম সমাজের চাপে স্কুলে যেতে না পারলেও মেধাবী শামসুন নাহারের মনে বিদ্যা অর্জনের দৃঢ় সংকল্প ছিল। ঘরে তাঁর পড়াশোনা থেমে থাকে নি এবং মনস্থির করলেন প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবেন। বিদ্রোহী নাহারের জন্য একজন হিন্দু শিক্ষক নিয়োগ করা হল। পাঠদানের পদ্ধতিও অভিনব। পড়ার টেবিলের ওপর ঝোলানো পর্দার এপাশে ছাত্রী, ওপাশে শিক্ষক। শিক্ষক পড়ান, ছাত্রী শোনেন। শিক্ষক লেখার কাজ দেন, ছাত্রী লিখে খাতাটা ঠেলে পর্দার ওপাশে পাঠিয়ে দেন। এভাবেই পড়াশোনা করে শামসুন নাহার চার বিষয়ে লেটার এবং স্টার-মার্কস সহ ম্যাট্রিক পাশ করেন।
সামাজিক নিষেধকে বাধ্য হয়ে মেনেছেন, কিন্তু নত হন নি শামসুন নাহার। সমাজ কারার দেওয়ালটাকে ধাক্কা মেরেছেন ভেতর থেকে। সেদিনের দৈত্য প্রাকারে আঘাত হেনেছিলেন রোকেয়া এবং আঘাতটাকে আরও তীব্র করে তুলেছিলেন শামসুন নাহার মাহমুদ, রোকেয়ার যোগ্য উত্তরসুরী হিসাবে। শামসুন নাহার তবু স্কুলে গেছেন, রোকেয়া সেটুকুও পারেন নি। তাঁর সময়ে অবরোধ ছিল আরও নির্মম। শামসুন নাহার সহযোগীতা পেয়েছিলেন তাঁর বড় ভাই হবীবুল্লাহ বাহার ও মায়ের কাছ থেকে। ততদিনে মাতামহ মারা গেছেন। ম্যাট্রিক পাশের পর নাহারের বিয়ে হয় ১৯৩২ সালে, আঠারো বছর বয়সে, উদার  হৃদয় ডাঃ ওয়াহিদ উদ্দীন মাহমুদের সঙ্গে। প্রগতিশীল মাহমুদ তাঁকে ভর্তি করে দেন কোলকাতার  ডায়েসেশান কলেজে। সত্যি বলতে, একদিকে ভাইয়ের আগ্রহ এবং অন্যদিকে স্বামীর নিবিড় উৎসাহ ব্যতিরেকে শামসুন নাহার যা হয়েছিলেন তা হতে পারতেন না। ১৯২৮ সালে তিনি আই এ পাশ করেন-- সবাইকে অবাক রে দিয়ে বিংশতিতম স্থান অধিকার করে। পরের বছর জন্ম হয় তাঁর প্রথম সন্তান, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, মামুন মাহমুদের। সংসার ও সন্তান সামলে দেরিতে ১৯৩২ সালে বি এ পাশ করেন। এই উপলক্ষে রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল নাহারের সংবর্ধনার আয়োজন করে। অভিনন্দনের জবাবে তিনি বলেন, আমি আশা করি, সেদিন দূরে নয়, আমাদের সমাজের মেয়েরা বি এ পাশ করে সংবর্ধনা পাবেন না-- সংবর্ধনা পেতে হলে তাদের আরও বড় কাজ করতে হবে”। আজ এ কথা বলাই যায়, শামসুন নাহারের গভীর অর্ন্তদৃষ্টিতে যে ছবি ধরা পড়েছিল তা এখন বাস্তব। বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক ১৯৩৯ সালে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন মুলতঃ মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার প্রসারের জন্য। সেখানে বি এ পাশ নাহারকে বাংলা বিভাগের প্রধান হিসাবে নিয়োগ করা হয়। শর্ত থাকে তিন বছরের মধ্যে এম এ পাশ করতে হবে। বি এ পাশের দীর্ঘ দশ বছর পর ১৯৪২ সালে শামসুন নাহার এম এ পাশ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তাঁকে ঢাকার ইডেন গার্লস কলেজে বদলি করা হয়। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি অধ্যাপার কাজ ছেড়ে দেন।
প্রত্যেক দায়িত্বশীল মানুষের কাছেই তার সময়ের কিছু জরুরী দাবী থাকে। এবং তাঁরা তা এড়াতে পারেন না। কেবল প্রাত্যহিক সাংসারিকতা তাদের সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়। অনেক সামাজিক কাজ তাদের করতে হয়, করতে হয় ত্যাগ স্বীকার । শামসুন নাহারও শুধু উচ্চশিক্ষা লাভ বা চাকরি করে তৃপ্ত থাকতে পারেন নি। সক্রিয়ভাবে শিক্ষা ও নারী আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের ধর্মান্ধতা ও পশ্চাদ্গামিতা তাকে পীড়িত করেছে সবসময়। রোকেয়ার সহকর্মী হয়ে শামসুন নাহারও সেই তিমির হননের সংগ্রামের নেমেছেন। রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত নিখিলবঙ্গ মুসলিম মহিলা সমিতির সম্পাদিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তৎকালীন ভারতের নারী সমাজের অধিকার আদায়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। সর্বোপরি মহিলাদের ভোটাধিকার আদায়ে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলনএর কলকাতা শাখায় যোগ দেবার পর নারীদের শিক্ষা, সামাজিক অধিকার, দুঃস্থ নারীদের সাহায্য করা, দূর্গতদের সেবা ও ত্রাণ বিতরণের কাজে অংশ নিয়েছেন। এই সময়ে তিনি অন্যান্য উচ্চশিক্ষিত অভিজাত মহিলাদের সাথে পরিচিত হন। তাদের মধ্যে ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, মিসেস সাধনচন্দ্র রায়, লেডী রানু মুখার্জী, এন.সি.সেন, মিসেস এ.সি. মুখার্জী, রেণুকা রায়, লেডী প্রমিলা মিত্র, লেডী অবলা বসু, শান্তা দেবী, সরলা দেবী চৌধুরানী প্রমুখের নাম বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। সম্মেলনের বার্ষিক অধিবেশনে যোগদানের জন্য তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে ঘুরবার সুযোগ পেয়েছেন। কাজের মাধ্যমেই তাঁর পরিচয় হয় আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ভারতীয় মহিলা বিজয়লক্ষী পণ্ডিত, সরোজিনী নাইডু, রাজকুমারী অমৃত কাউর, ময়ুরভঞ্জের মহারাণী সুচারু দেবী, বেগম হামিদা আলী, লেডী আব্দুল কাদির, বেগম শাহনওয়াজ প্রমুখের সঙ্গে। এছাড়াও বঙ্গীয় প্রাদেশিক শিক্ষাবোর্ড, প্রাদেশিক টেক্স্টবুক বোর্ড, লেডী ব্রেবোর্ন কলেজ, সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সদস্য হিসাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৩৬ সালে কোলকাতায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে তিনি বাংলার মুসলমান নারীদের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। এছাড়া ন্যাশনাল কাউন্সিল অব উইমেন ইন ইণ্ডিয়া, বেঙ্গল উইমেনএডুকেশন লীগ, বেঙ্গল প্রভেন্সিয়াল কাউন্সিল অব উইমেন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের মাধ্যমে তাঁর সকল আন্দোলন ভারতবর্ষে ব্যপক সাড়া জাগিয়েছে। শিক্ষা, সমাজ সেবা ও নারী প্রগতির ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ব্রিটিশ সরকার মাহমুদকে ১৯৪৪ সালে এম বি ই (Member of the British Empire) খেতাবে ভূষিত করেন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকায় চলে গেলেও তাঁর কর্ম তৎপরতা থেমে থাকেনি। তিনি পাকিস্তানের নারী শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য, ইউনেস্কোর পাকিস্তান শাখার সদস্য, প্রাদেশিক রেডক্রস সোসাইটির সদস্য, ঢাকা ইউনিভার্সিটি বোর্ড, বাংলা ভাষা সংস্কার কমিটি, রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের উপদেষ্টা, ঢাকা ইডেন কলেজ, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, আর্ট কলেজ, ফিল্ম সেন্সর বোর্ড, পাকিস্তান শিশু কল্যান পরিষদের সদস্য হিসাবে নারী সমাজের অগ্রগতির জন্য অবদান রেখেছেন। আর ঢাকাস্থ বুলবুল ললিতকলা একাদেমির সভানেত্রি হয়ে দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান সরকার মুসলিম বিবাহ ও পারিবারিক আইন সংশোধনের জন্য যে কমিশন গঠন করেন শামসুন নাহার তার সদস্য ছিলেন এবং একই বছরে প্রতিষ্ঠিত বাংলা একাডেমির নানা কাজে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থেকেছেন। শিক্ষা ও নারী প্রগতির নানা কাজে তিনি আমেরিকা, ইংল্যাণ্ড, প্যারিস, রোম, কলম্ব, তুরস্ক, টোকিও প্রভৃতি জায়গায় গিয়েছেন। তিনি টোকিওতে আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে মানবাধীকারে নারীর স্থান শীর্ষক আলোচনোয় যে বক্তৃতা দেন তা সকলের প্রসংশা লাভ করে।
শিক্ষা ও নারী প্রগতি ও সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি চলেছে তাঁর লেখার কাজ। সেই ছেলেবেলা থেকেই। মাত্র বারো বছর বয়সে লেখা কবিতা প্রণতি প্রথম প্রকাশিত হয় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত অঙ্গুর পত্রিকার ১৩২৭ এর আশ্বিন সংখ্যায়। আর ১৯২৫ সালের জানুয়ারী মাসে প্রথম পুণ্যময়ী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তাতে কাজী নজরুল ইসলামের একটি আশীর্বানী ছিল। কিন্তু নজরুল তখনও দেখেন নি শামসুন নাহার মাহমুদকে। এই বইটি আটজন মুসলিম মহীয়সী নারীর জীবন-চরিত। বইটির প্রশস্তিতে শহীদুল্লাহ লেখেন-- নারীর মহিমা, নারীর হৃদয়ের কথা, নারীর অধিকর, নারীর লক্ষ্য নারী যেমন বোঝে আমরা তেমনটি বুঝিতে পারি না। সেটি আমার কল্পনা, সেটি তাঁহাদের বাস্তব। লেখিকার হাতে নারী চরিত্র ফুটিয়াছে ভালো”। আর প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় নাহার আত্মকথা শিরোনামে মাত্র সতেরো বছর বয়সে তৎকালীন মুসলিম সমাজে নারীর দুর্দশা ও অবরোধ প্রথার প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেন। এবং মুসলমান সমাজপতিদের উদ্দেশ্যে বলেন, সমাজ তরণীর কর্ণধারগণ, এ বিষয়ে অবহিত হউন- মেয়েদের হৃদয়মন উচ্চ শিক্ষার আলোয় আলোকিত করুন”।
শামসুন নাহারের পরের বই ফুলবাগিচা ছোটোদের জন্য গল্প ও নীতিকথার সংকলন। তিনি পাঠান ও মোগল বেগমদের বিচিত্র জীবন কাহিনী নিয়ে রচনা করেন বেগম মহল’। এটা তাঁর তৃতীয় বই। নারী জাগরণই এই বই লেখার মুখ্য উদ্দেশ্য। স্যার যদুনাথ বেগম মহল সম্পর্কে জানান, সমাজের অর্ধ অংগ, সাম্রাজ্যের যাঁহারা অনেক সময়ই প্রকৃত প্রস্তাবে রাজার উপর রাজা ছিলেন সেই সব মহিলাগণ পর্দার ভিতর কি খাঁচার পাখির মত বাস করিতেন? এ প্রশ্নের উত্তর যে দেওয়া হয়েছে, তাহা পাঠকের হৃদয় অধিকার করিবেই”।
শামসুন নাহার মাহমুদের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক রচনা রোকেয়া জীবনী’। ছোট বই কিন্তু প্রাণবন্ত। বইতে আছে রোকেয়ার প্রতিভার সশ্রদ্ধ মূল্যায়ন। বইটি পড়তে গেলে মনে হয় কেবল রোকেয়ার কথা নয়, তাঁর নিজের কথাও বলেছেন তিনি। সেটাই স্বাভাবিক। উভয়ই তাঁরা অবরোধবন্দিনী ছিলেন। সেভাবেই থাকার কথা ছিল হয় তো, কিন্তু তাঁরা সেভাবে থাকতে প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁরা অন্ধকুপকে অন্ধকূপই মনে করছেন, তাকে বাসযোগ্য গৃহ মনে করেন নি। আমরা জানি সভ্যতার অগ্রযাত্রা অতীতের সঙ্গে বর্তমানের এবং বর্তমানের সঙ্গে ভবিষ্যতের সংযোগ ঘটায়। সমাজ এগিয়ে চলে। রোকেয়ার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের সুযোগ হয়েছিল। আর রোকেয়ার কথা লিখে গেছেন তাঁর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, যাদের সাথে রোকেয়ার প্রত্যক্ষ সংযোগ ঘটবে না, কিন্তু তিনি প্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করে যাবেন অনাগত সময়ে। মায়ের আগ্রহে ও ভাইয়ের উৎসাহে নাহার রোকেয়া জীবনী লেখেন। এ বই সম্পর্কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, সুলেখিকা শামসুন নাহার সাহেবা রোকেয়ার এই জীবনীখানি রচনা করিয়া সকলের সাধুবাদ অর্জন করিয়াছেন। আমরা জানি রোকেয়ার সবচেয়ে বড় সংগ্রাম ছিল তৎকালীন রক্ষণশীল ও ধর্মান্ধ মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে। মুসলিম নারীমুক্তি ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র”। মোহিতলাল মজুমদার লিখেছেন, এই জীবনী যিনি লিখেছেন, তিনিও সামান্যা নহেন। তিনি যে এমনভাবে এই চরিত্রটি গড়িয়া তুলিয়াছেন তার কারণ তিনি এই জীবনকে মনে ও প্রাণে গ্রহণ করিতে পারিয়াছেন। ......যে আদর্শ ওই জীবনে ও চরিত্রে বিদ্যমান ছিল, সে আদর্শকে তিনি নিজের অন্তরে চাক্ষুষ করিতে পারিয়াছেন। তাঁহার হৃদয়ও ঐ একই ছাঁচে গড়া”। অদ্বৈত মল্লবর্মন রোকেয়া জীবনী আলোচনা করেছেন এই ভাষায়, সমগ্র গ্রন্থখানা আগাগোড়া একখানা মনোরম উপন্যাসের মতই এক নিশ্বাসে শেষ করিবার মত। ভাষার সংযম এবং শুচিতাও গ্রন্থখানার অন্যতম সম্পদ। বাংলার প্রত্যেক শিক্ষানুরাগিনী মহিলা ও শিক্ষার্থীগণের হাতে এই গ্রন্থখানা শোভা পাইবে বলিয়াই আমাদের বিশ্বাস। বিশেষ করিয়া, স্কুলের মেয়েদের পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার এ বইখানা সর্বাংশে যোগ্য”। নাহার তাঁর বইতে রোকেয়ার মুখ দিয়ে নিজের অন্তরের কথাই বলেছেন। শিক্ষা-বিরোধী ধর্মের ধ্বজাধারীদের সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, শিক্ষা না পাইলে লোকে স্রষ্টাকেও চিনিতে পারে না। যে সকল মোল্লা স্ত্রী শিক্ষার বিরুদ্ধে ফতোয়া দেন তাহারা ছদ্মবেশি শয়তান”।
তাঁর পরবর্তী প্রকাশনা ১৯৩৯ সালে। এটি শিশুর শিক্ষা বিষয়ক একটি মুল্যবান তথ্য সমৃদ্ধ বই। আজ শিশু-মনস্তত্ব নিয়ে দেশি ও বিদেশি ভাষায় অনেক বই পাওয়া যায়, লেখালেখিও হচ্ছে প্রচুর। কিন্তু শামসুন নাহার যখন শিশুর শিক্ষা লিখেছিলেন তখন বাংলা ভাষায় এ বিষয়ে বইপত্র ছিল না বললেই চলে। এই বই পড়লে শিশু পালন ও শিশু শিক্ষার মনস্তাত্ত্বিক অনেক ব্যবহারিক বিষয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় যা খুব প্র‍যোজনীয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বইটির প্রশংসা করে চিঠি লিখেছিলেন, তোমার সকল রচনাকেই আমি অন্তরের সাথে প্রশংসা করে থাকি। কী ভাষায়, কী মনন শক্তিতে, কী সরসতায়, তোমার লেখা যে বিশিষ্ঠতা লাভ করেছে আমি তার প্রশস্তিবাদ তোমাকে পাঠাই তোমার গ্রন্থে তার ব্যবহার করতে পার”। আটটি অধ্যায়ে বইটি বিভক্ত। প্রত্যেক অধ্যায় শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ বা অন্য কোন কবির কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে। শামসুন নাহারের শিশুর শিক্ষা বইটির ভূমিকা লিখেছেন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আজিজুল হক। শিশুর বেড়ে ওঠার সময়ে এই বইটি আজও প্র‍যোজনীয় বলেই মনে হয়। তবে শুধু বই লিখেই ক্ষান্ত হন নি শামসুন নাহার। আজীবন তিনি শিশু ও নারী-শিক্ষা ও মানসিক বিকাশের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। শিশু ও নারীর অধিকার অর্জন ও নির্যাতন রোধের যে আন্দোলন, তার পুরোধা ছিলেন রোকেয়া, পরে শামসুন নাহার মাহমুদ।
পাকিস্তানের একটি সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হয়ে শামসুন নাহার মাহমুদ ১৯৫২ সালে তুরস্ক ভ্রমণে যান। ফিরে এসে লেখেন একটি ভ্রমণ বৃত্তান্ত আমার দেখা তুরস্ক’। এই গ্রন্থে তিনি তুরস্কের সামাজিক রীতি-নীতি, শিক্ষা স্বাস্থ্য ও নারীর অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তুরস্কের দৃষ্টান্ত দিয়ে বর্তমান পৃথিবীর বিশেষভাবে এই উপমহাদেশের মেয়েদের আধুনিকতার যাত্রী হতে আহ্বান জানিয়েছেন।
শামসুন নাহার মাহমুদের সবশেষ গ্রন্থ নজরুলকে যেমন দেখেছি, প্রকাশকাল ১৯৫৮সাল। তাঁর উপর যেমন ছিল রোকেয়ার প্রভাব, তেমনি ছিল কাজী নজরুলেরও অপরিসীম প্রভাব। সেটা ছিল বাঙালি মুসলমানের জাগরণের কাল। এই জাগরণের প্রধান দুই ব্যক্তিত্ব রোকেয়া ও নজরুল। দুজনের সংস্পর্শে এসে উজ্জীবিত ও প্রাণিত হয়েছিলেন হবিবুল্লাহ বাহার ও শামসুন নাহার। আর দুজনের মধ্যেই ছিল বড়োত্বের তৃষ্ণা। ১৯২৬ সালে হেমন্ত কুমার সরকারের সঙ্গে বাহারেরই আমন্ত্রণে নজরুল চট্টোগ্রামে যান। ১৯২৯ সালে আরও একবার তিনি চট্টগ্রাম ভ্রমণে গিয়েছিলেন। দুবারই ওঠেন বাহার-নাহারদের বাড়ি এবং কয়েক সপ্তাহ অবস্থান করেন। সে সময়ে চট্টগ্রামে নজরুলের আগমনে বেশ সাড়া পড়েছিল। নজরুলের অনেক বিখ্যাত কবিতা রচিত হয় এই সময়ে। সেই কবিতাগুলির মধ্যে রয়েছে সিন্ধু, শীতের সিন্ধু, গোপন প্রিয়া, অনামিকা, কর্ণফুলি, মিলন মোহনায়, বাতায়ন পাশে, নবীনচন্দ্র, বাংলার আজিজ শিশু যাদুকর, সাত ভাই চম্পা ইত্যাদি। এই কবিতা পরে কবি তার সিন্ধু-হিল্লোল, ও চক্রবাক কাব্যগ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত করেন। নজরুল সিন্ধু-হিল্লোল কাব্যগ্রন্থ তার বাহার-নাহারকে উৎসর্গ করেছেন। শামসুন নাহারের নজরুলকে যেমন দেখেছি বইটি আয়তনে ছোট কিন্তু অন্তর্মূল্যে মহার্ঘ। নানা টুকরো মন্তব্যের মধ্য দিয়ে এই স্মৃতি কথায় নজরুল জীবন্ত হয়ে উঠেছেন। অবশ্য শুধু নজরুল নন, জীবন্ত হয়ে উঠেছে সেই দেশ, সেই কাল। আজ ভাবতে অবাক লাগে কতকাল আগে বাংলার সমাজে ও সংস্কৃতিতে নজরুল ইসলামের মহত্ব অনুভব করেছিলেন হবীবুল্লাহ বাহার ও শামসুন নাহার। তাঁরা বরণ করেছিলেন শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায়। আর নজরুলও নানা সময়ে তাঁদের অনুপ্রাণিত করেছেন। নজরুল একবার শামসুন নাহারকে চিঠিতে মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার সমস্যা সম্পর্কে লিখেছিলেন, কত মেয়েকে দেখলাম কত প্রতিভা নিয়ে জন্মাতে, কিন্তু সব সম্ভাবনা তাদের শুকিয়ে গেল সমাজের প্র‍যোজনের দাবীতে। ঘরের প্র‍যোজন তাদের বন্দিনী করে রেখেছে। তাই নারীদের বিদ্রোহিনী হতে বলি”। ১৬৫৯ সালে আব্দুল কাদির সম্পাদিত নজরুল পরিচিতি গ্রন্থে নজরুলের প্রতিভার নানা দিক নিয়ে যাঁরা লিখেছেন তাঁদের অন্যতম হলেন শামসুন নাহার মাহমুদ।
তবে শামসুন নাহারের বিরাট ভাগ্য যে তিনি রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ লাভ করে ধন্য হয়েছিলেন। কবি কোলকাতায় থাকার সময়েই তাঁর সাথে নাহারের প্রথম সাক্ষাৎ হয়। কিন্তু শামসুন নাহারের প্রতিভার ও কীর্তির সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি এসেছে যখন তাঁকে কবির মৃত্যুর কয়েকমাস আগে শান্তিনিকেতনের বাৎসরিক উৎসবে মহিলা শাখার সভানেত্রীত্ব করার জন্য আমন্ত্রণ করা হয়। এবং প্রথমবারের জন্য তাঁর শান্তিনিকেতনে গমন ও রবীন্দ্রনাথের অতিথি হয়ে তিনদিন উত্তরায়ণে অবস্থান। সেখানে কবি, ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী, সরলাদেবীসহ কবির পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
নাহার নারী শিক্ষা, নারীর অধিকার নিয়ে আন্দোলন, লেখালেখি ছাড়াও পত্রিকা সম্পাদনার কাজ করেছেন। ১৯৩৩ সালে হবিবুল্লাহ বাহার ও শামসুন নাহারের যুগ্ম সম্পাদনায় বুলবুল নামে একটি উন্নত রুচির পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় সে সময়ের অধিকাংশ বিখ্যাত লেখক লিখেছেন। তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, আবুল ফজল, প্রমথ চৌধুরী, ইন্দীরা দেবী, কাজী আব্দুল ওদুদ, দিলীপ রায়, হুমায়ুন কবীর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শামসুন নাহারদের সম্পাদিত অভিজাত পত্রিকার প্রথমবর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যায় সম্পাদকীয় মন্তব্য ছিল-- রাজনীতি ক্ষেত্রে মানুষকে সব সময় হিন্দু ও মুসলমান এই দুই দলে ভাগ করে দেখা ভুল। আজকাল অনেকেই এ সম্বন্ধে সজাগ হয়ে উঠছেন। ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রে অর্থনীতির ভিত্তির উপর যখন দল গড়ে উঠবে, তখন তথাকথিত হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে আশা করা যায়”। হিংসা ও বিদ্বেষের রাজনীতিতে তাদের যে আস্থা ছিল না তা সহজেই অনুমান করা যায়। বুলবুল পত্রিকার মাধ্যমে তারা সুস্থ সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। বুলবুল পত্রিকা রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিল। পত্রিকায় কবির একটি চিঠি শুভবুদ্ধির আহ্বান নামে ছাপা হয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, আত্মবিচ্ছেদ ও ভ্রাতৃবিদ্বেষে দেশের হাওয়া যখন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে, সেই সময় পরম দুর্যোগের দিনে নিষেধের বাণী কোথাও ধ্বনিত হতে পারল একে আমি শুভ লক্ষণ বলে মনে করি। ...... এই দুর্ভাগ্যের নিষ্ঠুর আঘাতে দেশের নির্বোধ জড়ত্বে যে বেদনার সঞ্চার আরম্ভ হয়েছে তোমাদের পত্রে এ তারই লক্ষণ সূচিত”। পরবর্তী সময়ে ঢাকায় সংস্কৃতি-চর্চা কেন্দ্র বুলবুল ললিতকলা একাডেমির শামসুন নাহার ছিলেন আমৃত্যু প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। হবিবুল্লাহ বাহার ও শামসুন নাহার সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় অনেকগুলো বছর হাত ধরাধরি করে চলেছেন। কর্মযজ্ঞে একজন হয়ে উঠেছিলেন অন্যের পরিপুরক। ভাই-বোনের কাজে ও লেখায় আজীবন মিত্রতা বড় একটা দেখা যায় না। ১৯৬৪ সালের ১০ই এপ্রিল মাত্র ছাপ্পান্ন বছর বয়সে এই শিক্ষাবিদ, সমাজসেবী, সাহিত্যিক, কর্মী, সকল সামাজিক প্রতিকূলতা পেরিয়ে অনন্য দিশারী শামসুন নাহার মাহমুদের মৃত্যু হয়।
এক অন্ধকারাচ্ছন্ন নারী-সমাজকে আলোর দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছেন রোকেয়া ও শামসুন নাহার। ঢাকা বিশ্ব্বিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে নাহার বলেছিলেন, তোমরা জন্মেছ উজ্জ্বল আলোকের প্লাবনের মধ্যে, আর আমাদের জন্ম গভীর অন্ধকারে, অন্ধকারেই হয়েছে আমাদের যাত্রা শুরু। অন্ধকারকে ভেদ করে এসে উত্তীর্ণ হয়েছি আমরা আলোকের তীরে। আলো তোমাদের কাছে এসেছে সহজ স্বাভাবিক ভাবে। আর আমরা আলো জয় করে নিয়েছি। আলো হয়তো সেই জন্য আমাদের কাছে বেশী মূল্যবান”। আবার সেই আলোকের পথে বর্তমান বাঙালি নারীরা কতটা সাফল্যের সাথে অগ্রসর হতে পেরেছে তা মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। এখনও মেয়েদের চলার পথ সম্পূর্ণ আলোকময় হয় নি এবং পথের বাঁকে বাঁকে অসংখ্য বাধার পাহাড়। বাঙালী নারীর অগ্রযাত্রায় আরও অনেক শিকল ছিন্ন করতে হবে আগামীতে এবং এই কাজে শামসুন নাহারের সাহস, প্রজ্ঞা ও দৃঢ মনোবলের দৃষ্টান্ত প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে অনেক কাল।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বুলবুল আহমেদ

সংস্কৃতির নিঃসঙ্গ পথিক মন তুমি কৃষি-কাজ জাননা, এমন মানব জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা। --- রাম প্রসাদ সেন মানব-জনমে ফসল ফলে না নানা কারনে, সোনা ফলা অনেক পরের ব্যাপারে। সবচেয়ে বড়ো প্রতিরোধের সৃষ্টি করে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক প্রতিবেশ। সেখানে মননের অভাব, প্রীতির অভাব, প্রেমের অভাব, বন্ধুতার অভাব সংযমের অভাব, সবচেয়ে বড় অভাব আত্মমর্যাদার। আর এতগুলো না-থাকা জায়গা করে দেয় নিখিল নিচতা, শঠতা, সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতার জন্য। নিজের জীবনে মানুষের অবাধ অধিকার। জগৎকে মেরামত করে এইসব হীনবৃত্তি দূর করার চেয়ে নিজেকে সংশোধন করা অধিক প্রয়োজন। এই কাজে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রয়েছে সংস্কৃতি চর্চার। ধর্ম নয়, রাজনীতি নয়, মতবাদী নয়, মুক্তির পথ দেখায় সংস্কৃতি –  মানুষ নিজেকে খুঁজে পায়। এই কথা বলেছেন মোতাহার হোসেন চৌধুরী (১৯০৩- ৫৬) একান্ত নিভৃতে ‘সংস্কৃতি-কথা’ প্রবন্ধ সংকলনে। তাঁর ভাবনার আকাশে মেঘের মত ছায়া ফেলেছেন ক্লাইভ বেল ও বার্ট্রাণ্ড রাসেল। তিনি আমাদের শুনিয়েছেন শুভবোধের, নিরঞ্জন বুদ্ধির, উচ্চকিত যুক্তির ও ব্যক্তিপ্রত্যয়ের কথা।

আবদুল হক

একজন গোবিন্দ দেব ও তাঁর নীরবতা দিবস গোবিন্দচন্দ্র দেব কেবল পণ্ডিত ও দার্শনিক ছিলেন না, জীবনযাপনে আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন একজন পরহেযগার মানুষ। নীরব ধ্যানী, নিবিষ্ট চিন্তক, নিভৃত সাধক। আমরা কেউ পুণ্যবাদী, কেউ পুঁজিবাদী। তিনি এ দুয়ের বাইরে গিয়ে, উর্ধে উঠে, হয়েছিলেন মানুষবাদী।

সত্যরঞ্জন বিশ্বাস

প্রেক্ষিত চড়কঃ মুসলিম ও অন্যান্য অনুষঙ্গ বর্ষশেষের উৎসব হিসাবে ‘ চড় ক ’ বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি লোকোৎসব। গ্রামবাংলার নিম্নবর্গীয় শ্রমজীবি মানুষেরাই চড়ক উৎসবের মূল হোতা। দরিদ্রদের এই মহোৎসবকে বসন্তোৎসব হিসাবেও গণ্য করা যায়।